মোহাম্মদ আশরাফুল হক
সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএফআরআই ও পিএইচডি ফেলো
বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমা অর্থাৎ ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সাগরের পুরোটই বঙ্গোপসাগরের অর্ন্তভুক্ত। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রিভার সিস্টেম গঙ্গা-ব্রম্মপুত্র-মেঘনা বা পদ্মা-যমুনা-মেঘনা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপুল পরিমাণ স্বাদু পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। যার ফলে বাংলাদেশের উপকুল ও সাগরের পানি পৃথিবীর অন্যতম উর্বর জলরাশি হিসাবে স্বীকৃত, যেখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রসহ বিশে^ বিপন্নপ্রায় বিরল কয়েকটি সামুদ্রিক জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল (হট স্পট)। যার মধ্যে রয়েছে মহাসাগরীয় জায়ান্ট হিসাবে পরিচিত কয়েক প্রজাতির তিমি ও ডলফিন।
পৃথিবীর মোট ৬৪টি লার্জ মেরিন ইকোসিস্টেম বা সমুদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে আমাদের বঙ্গোপসাগরও অন্যতম। বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের একটি অংশ। বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে সর্বোচ্চ প্রায় ১ কিলোমিটার গভীরতাসম্পন্ন একটি সমুদ্র তলদেশীয় আর্ন্তজাতিক খাদ বিদ্যমান, যা ভারতীয় অংশে ৪০ কি.মি. প্রশস্থ এবং বাংলাদেশে উপকুলে খাদের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র ৬ কি.মি. প্রশস্থ হয়ে এর সমাপ্তি ঘটেছে; এই খাদটিই ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ নামে পরিচিত । বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগরে বিশে^র বিপন্ন স্তন্যপায়ী জায়ান্টদের সুরক্ষার জন্য ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এর ১,৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকাকে Marine Protected Area (MPA) বা সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করেছে।
জনৈক একেএম আমিনুল হক (২০১৪) সম্পাদিত বাংলাপেডিয়ার বাংলাদেশের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাইট- এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ অঞ্চলে চট্টগ্রামের কাছে ১৮৪২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি তিমি আটকে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। তখন তিমিটিকে Balaenoptera গণের অর্ন্তভুক্ত প্রজাতি বলে সনাক্ত করা হয়েছিল।
Wildlife Conservation Society (WCS) এর সর্বশেষ জরীপ মতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। যার মধ্যে ৪ প্রজাতির তিমি, ৭ প্রজাতির শুশুক (ডলফিন) ও এক প্রজাতির হুছুম (পরপইস)। বাংলাদেশে থাকা চার প্রজাতির তিমির মধ্যে ব্রাইডিস বা বলিন তিমি (Bryde’s whale, Balaenoptera edeni/brydei), গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি (Sperm Whale, Physeter macrocephalus), ঘাতক তিমি বা চিতা তিমি (Killer Whale, Orcinus orca) এবং ছদ্ম ঘাতক বা নকল চিতা তিমি (False-killer Whale, Pseudorca crassidens ) ইত্যাদি।
International Union for Conservation of Nature (IUCN) বাংলাদেশ এর ২০১৫ সালের জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ৩ প্রজাতির তিমি রয়েছে। এগুলো হলো ব্রাইডিস বা বলিন তিমি (Bryde’s whale, Balaenoptera edeni/brydei), গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি (Sperm Whale, Physeter macrocephalus) এবং ছদ্ম ঘাতক বা নকল চিতা তিমি (False-killer Whale, Pseudorca crassidens) ।
[বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকুলে কি তিমি আছে?
বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এ তিমির আবাসস্থল রয়েছে, যেখানে সর্বশেষ জরীপে চার প্রজাতির তিমির বসবাস সনাক্ত হয়েছে। কিন্তু অনেকেরই প্রশ্ন- বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকুলেও কি তিমিরা বাস করে? আমার উত্তর হল- সম্ভাবনা আছে। কারণ ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এর মতোই কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন উপকুলের কাছেই ‘বার্মা ট্রেঞ্চ’ নামে আর্ন্তজাতিক সমুদ্র তলদেশীয় খাদ রয়েছে এবং ডঈঝ এর ২০১৭ ও ২০১৮ সালের এক জরীপে গবেষকদল কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে সাগর ‘বার্মা ট্রেঞ্চ’ এ ব্রাইডিস বা বলিন তিমির জীবিত মা ও শাবক তিমিকে একসাথে দেখেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া লেখক নিজে আনুমানিক ২০০৯ সালে কক্সবাজারের বাংলাদেশ মৎস্য অবতরন কেন্দ্র প্রায় ১৮ ফুট লম্বা মৃত একটি স্পার্ম হুয়েল (গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি) দেখেছেন, যা টেকনাফ সংলগ্ন সমুদ্র থেকে পার্চসিন জালে জীবিত ধরা পড়েছিল বলে জেলেরা তাকে জানিয়েছিলেন। এছাড়া কক্সবাজারে বিভিন্ন উপকুল বিভিন্ন সময়ে মৃত তিমি ভেসে আসে। যেমন; ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে লাবনী পয়েন্টে, ২০২০ সালে শাহপরী দ্বীপের বাংলা চ্যানেলে এবং সর্বশেষ গত মাসের (এপ্রিল, ২০২১) ৯ ও ১০ তারিখে হিমছড়িতে দুটি মৃত তিমি ভেসে আসে। আর ২০২০ সালের ২৩ শে মার্চ লকডাউনের সময় কক্সসবাজারের সুগন্ধা সৈকতের কাছে সাগরে খেলারত গোলাপী ডলফিনের ঝাক সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এছাড়া সৈকতের বিভিন্ন স্থানে মাঝে মধ্যে মৃত ডলফিন ও পরপইজ দেখা যায়। এ জাতীয় তথ্যসমুহ সম্ভাবনা জাগায় যে, ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এর মতো তিমির স্থায়ী আবাস স্থল না হলেও কক্সবাজার সংলগ্ন সামুদ্রিক অঞ্চল তিমিসহ সিটাসিয়ানের সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ ফিডিংগ্রাউন্ড ও বিচরণক্ষেত্র। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা জরীপের মাধ্যমে এ সম্পর্কে একটি স্পষ্ঠ ধারণা পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশে হাম্পব্যাক তিমি (Megaptera novaeangliae) এর অস্তিত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি
বাংলাপেডিয়ার বাংলাদেশের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাইটে সমুদ্রতীরে আটকে পড়া মৃত তিমির মধ্যে Megaptera novaeangliae ছিল বলে উল্লেখ থাকলেও বর্তমান হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ভারত মহাসাগরের অন্তভুক্ত আরব সাগরের মধ্যেই Megaptera novaeangliae বা হাম্পব্যাক তিমির আবাস ও বিচরণ সীমাবদ্ধ বলে জানা গেছে। বিগত ২০১৮ সালে আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যের উপকুলে একটি মৃত হাম্পব্যাক তমিি ভেসে আসার খবর জানা যায়, যা আরব সাগরের উপকুল। হাম্পব্যাক তিমি আরব সাগরের পূর্ব সীমানা অর্থাৎ মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার পশ্চিম দিকের উপকুল পর্যন্তই বিচরণ সীমাবদ্ধ রাখে বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। হাম্পব্যাক তিমি ভারত মহাসাগরে বসবাস করলেও তা মূলত: আরব সাগরেরই সীমাবদ্ধ এবং এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে হাম্পব্যাক তিমি (Megaptera novaeangliae) এর অস্তিত্ব থাকার শক্তিশালী কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।